শিল্প কি নিছক পেট চালানোর উপায়? নাকি সমাজের কাছে, আবহমান কালের কাছে এক আত্মিক দায় নিয়ে শিল্পের জন্ম? এ প্রশ্ন চিরন্তন। আর যখনই এই প্রশ্ন আমাদের চেতনাকে নাড়া দিয়েছে তখনই উদ্ধত শালপ্রাংশু কোনো না কোনো শিল্পীমন নৈমিত্তিকতার প্রলোভনকে তুড়ি মেরে অস্বীকার করেছে, অগ্রাহ্য করেছে। কিন্তু চিরন্তনের কাছে যার দায় সেই শিল্পকে হেরে যেতে দেয়নি। বেইমানি করেনি শিল্পীসত্তার সঙ্গে, মানুষের সঙ্গে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পের মদন তাঁতী এমনই এক চরিত্র। সেই মদন তাঁতির ভালোবাসা, জেদ ও সংগ্রামের গল্প নিয়ে দৃশ্যপটের সাম্প্রতিকতম প্রযোজনা ‘শিল্পী’। অনির্বাণ ভট্টাচার্য্যের পরিচালনায়, ৮ মে, দৃশ্যপট নাট্যদলের ৩৮ তম জন্মদিনে একাডেমিতে মঞ্চস্থ হল শিল্পী নাটকটি। নাটকটিকে ঠিক ‘শিল্পী’ গল্পের নাট্যরূপ বলা চলে না হয়ত বরং বলা ভালো মানিকবাবুর গল্পের মূল ভাবকে অক্ষুণ্ণ রেখে, তাঁর ভাবনা ও মতাদর্শের সূত্রটিকে ছিন্ন না করে এক শিল্পীর জীবনসংগ্রামের বিভিন্ন স্তরকে ছোঁয়ার চেষ্টা করেছেন নাটককার উজ্জ্বল মণ্ডল। এ এক শক্তিশালী, স্বতন্ত্র নির্মাণ। নাটককার হিসেবে তিনি তাঁর পরিচয়কে আরো দৃঢ়তার সঙ্গে সুস্পষ্ট করেছেন এই নাটকে, সন্দেহ নেই।
অন্তরে বাহিরে দ্বন্দ্বে বিপর্যস্ত মদন তাঁতি। তাঁত না চালিয়ে গাঁটে ব্যথা। অনাহারে ক্লিষ্ট সন্তান। স্ত্রীর গঞ্জনা অন্যদিকে শিল্পীর আত্মসম্মান, শিল্পের প্রতি তার দায়। এ দ্বন্দ্ব প্রয়োজনের সঙ্গে নৈতিকতার দ্বন্দ্ব। সাময়িকের সঙ্গে চিরন্তনের দ্বন্দ্ব। নিছক টিকে থাকার সঙ্গে বেঁচে থাকার দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্ব কে আরো ঘনিয়ে তোলে ভুবন মহাজনের মত লোক। অভুক্তের সামনে ভাতের থালা বাড়িয়ে দিয়ে যে শিল্পকে হাটে কিনতে চায়। সফল হয় কি সে? এক গভীর রাতে মদনের ঘর থেকে তাঁতের শব্দ ওঠে। প্রবল আলোড়নের মতো সে শব্দ আছড়ে পড়ে তাঁতিপাড়ার বুকে। দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে চলা মানুষগুলোর শেষ ভরসাটুকু যেন নিঃশেষ হয়ে যায় সেই শব্দে। কি মদন তবে বেইমানি করল তাদের সঙ্গে? না, মদন বেইমানি করেনি। মদনেরা মরতে জানে, বেইমানি করতে জানে না। গাঁটের ব্যথা কাবু করার জন্য সুতো ছাড়াই ফাঁকা তাঁত চালিয়েছে সে। ভুবন মহাজনের লোভাতুর মুখের ওপর যেন থাপ্পড়ের মতো আছড়ে পড়ে মদনতাঁতির খালি তাঁতের শব্দ। যারা ভাবে, যে কোনও মূল্যেই শিল্পকে কিনে নেওয়া যাবে, তাদের বেনিয়া বুদ্ধির ওপরে স্পর্ধার মতন আছড়ে পড়ে হতদরিদ্র, অভুক্ত মদন তাঁতির খালি তাঁতের শব্দ। লড়াই এভাবেই চলে। চলেছে চিরটাকাল। আর এই লড়াইয়ের গতিপথ চিনে নিতে মঞ্চে যে আশ্চর্য রূপকথা সৃষ্টি করেছেন পরিচালক অনির্বাণ ভট্টাচার্য্য তা দর্শককে আবিষ্ট করে। তিনি বরাবরই মঞ্চে ছবি তৈরী করতে ভালোবাসেন। আমরা যারা বাবলি, আগুনের বর্ণমালা, ওয়াদিপাউস, চারু দেখেছি তারা তা জানি। তবে এই নাটকে তিনি মুহুর্ত ও ছবির যেন এক কবিতা সৃষ্টি করেছেন মঞ্চে। বহুদিন বাংলা থিয়েটার এমন মায়াময় নির্মাণের সাক্ষী থাকেনি। ধন্যবাদ অনির্বাণকে। এই মায়ার খেলায় তাকে যোগ্য সঙ্গত দিয়েছেন মনোজপ্রসাদের আলো এবং অর্পণ ঠাকুর চক্রবর্তীর আবহ। আপাতভাবে সহজ বলে মনে হলেও এই নাটকের আলোর বুনট যথেষ্ট জটিল। তবে সেই প্রযুক্তিগত জটিলতার ধাঁধা পেরিয়ে দর্শকমনে আলোর আবেশ ছড়িয়ে দিয়েছেন প্রক্ষেপক অত্রী ভট্টাচার্য্য। মনোজপ্রসাদের সঙ্গে সঙ্গে ধন্যবাদ তারও সমান প্রাপ্য। এই নাটকের অন্যতম প্রাপ্তি এর আবহ। নাটকের মূল সুরের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ ভাবে সমস্ত দেশজ বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারে সুরের যে মায়াজাল তৈরী করেছেন অর্পণ ঠাকুর চক্রবর্তী তা এক কথায় অসাধারণ। আকাশ চক্রবর্তীর লেখা গানে এই সুরের বুনন যেন পূর্ণতা পেয়েছে। যথাযথ প্রক্ষেপণে এই আবেশকে অক্ষুণ্ণ রেখেছেন প্রক্ষেপক গৌতম পাল। স্বল্প উপকরণে বিষয়ানুগ এক অসাধারণ মঞ্চ পরিকল্পনায় তার দক্ষতা দেখিয়েছেন শিল্পী উৎসব রাউত, মঞ্চ নির্মাণে পার্থ মজুমদার ও সুরজিৎ দে।
এবারে আসি অভিনয় প্রসঙ্গে। পরিচালক নাটকটিকে যে তারে বেঁধে দিয়েছেন তা অভিনেতাদের যোগ্য সঙ্গত ছাড়া কখনোই সম্ভব হত না। একঝাঁক অভিনেতা তাদের নিজস্ব ভঙ্গিমায় ও জোরে পরিচালকের ভাবনাকে নির্মাণ করেছে এই নাটকে। মদনতাঁতির যন্ত্রণা, সংগ্রাম ও ভালোবাসার বিভিন্ন স্তরকে অসাধারণ দক্ষতায় মঞ্চে মূর্ত করেছে অভিনেতা উদ্ভাস রায়। তাকে যোগ্য সঙ্গত দিয়েছে স্ত্রীর ভূমিকায় পিউ কুন্ডু এবং উদীর ভূমিকায় পৃথা রায়চৌধুরী। নজর কাড়ে বৃদ্ধা মাসির ভূমিকায় তানিয়া পাত্র এবং বৃদ্ধ তাঁতির ভূমিকায় তুহিন ভট্টাচার্য্য। সংক্ষিপ্ত পরিসরে অভিনেতা হিসেবে নিজেদের জাত চিনিয়েছে মিহিরবাবুর ভূমিকায় তারাশঙ্কর ভট্টাচার্য্য, ভুবনের ভূমিকায় পার্থপ্রতিম নাথ এবং গগন তাঁতির ভূমিকায় উজ্জ্বল মণ্ডল। মন ছুঁয়ে যায় মদন তাঁতির সন্তানের ভূমিকায় অত্রীশ মুখোপাধ্যায়ের অভিনয়। এছাড়াও ছোট চৌধুরীর ভূমিকায় গৌরব দাশগুপ্ত, কীর্তন গায়িকার ভূমিকায় পিয়ালি ভট্টাচার্য্য, বৃন্দাবন তাঁতির ভূমিকায় প্রদীপ কুমার কাহালি এবং তারক তাঁতির ভূমিকায় উৎসব রাউত যথাযথ অভিনয় করেছেন। যে সংগ্রামের দৃপ্ত ঘোষণায় নাটকটি শেষ হয়েছে তাকে কাঙ্খিত অভিঘাত ঘটাতে সাহায্য করে অত্রী ভট্টাচার্য্যের অসাধারণ এক কোরিওগ্রাফি। সব মিলিয়ে এ নাটকের রেশ বহুদিন দর্শকমনে থেকে যাবে। এমন দলগত প্রয়াস বর্তমান বাংলা নাটকে প্রায় বিরল। এজন্য বিশেষ ধন্যবাদ প্রাপ্য দৃশ্যপট নাট্যদল ও তার পরিচালক অনির্বাণ ভট্টাচার্য্যের।