আজ যখন বিশ্বজুড়ে পরিবেশ বিপন্ন, সেই সময় অত্যন্ত সময়োপযোগী ‘পরিবেশ রক্ষা করো’ – এই আহ্বান দিয়ে কলকাতার বুকে পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয় এবং পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের বেলগাছিয়া বিজ্ঞান কেন্দ্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান সভার যৌথ উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিটি হলে ৫-৭ জানুয়ারি,২০২৪ অনুষ্ঠিত হচ্ছে ‘আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় স্মারক বিজ্ঞান মেলা ও প্রদর্শনী’।
মেলার শুরুতে সুন্দর এক পদযাত্রা শেষে ‘বাংলায় বিজ্ঞান চর্চা’র মণ্ডপের ফিতে কেটে ৫ ই জানুয়ারি মেলার উদ্বোধন করেন জুলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার মাননীয়া অধিকর্তা ড. ধৃতি ব্যানার্জী। উদ্বোধনী ভাষণে তিনি বলেন প্রকৃতি সুন্দর না থাকলে মানুষ কখনোই ভালো থাকতে পারেনা। মেলার সম্মানীয় অতিথি বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের সভাপতি ড. সুমিত্রা চৌধুরী সল্প পরিসরে তুলে ধরেন বাংলার বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাস। ছাত্র জীবন থেকে বিজ্ঞান চর্চার উপরে বিশেষ আকর্ষন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তাকে গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানান বিশ্ববদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক শ্যামসুন্দর দানা। সকল মানুষকে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী ভাবনায় উজ্জীবিত করতে সারা ভারত বিজ্ঞান প্রসার আন্দোলনের অঙ্গ হিসাবে এই বিজ্ঞান মেলার প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরেন পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক প্রদীপ কুমার মহাপাত্র এবং পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের কলকাতা জেলার সম্পাদক শেখ সোলেমান। আজকের দিনে পুরানকে ইতিহাস চর্চার অঙ্গ হিসাবে তুলে ধরার যে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ শুরু হয়েছে তা প্রতিহত করে সকলের মনে বিজ্ঞান মনস্কতা গড়ে তোলা আজকের দিনে বড়ো চ্যালেঞ্জ বলে জানান মেলা কমিটির সভাপতি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক চন্দ্র শেখর চক্রবর্তী। মেলায় বিশ্ববিদ্যালয় ও স্থানীয় এলাকার মানুষজনের সমবেত উদ্যোগকে স্বাগত জানান বিশ্বিদ্যালয়ের নিবন্ধক অধ্যাপক পার্থ দাস ও মেলা কমিটির সম্পাদক শ্রী অনিন্দ্য চৌধুরী। ধন্যবাদ জ্ঞাপন ভাষণে মেলা কমিটির কার্যকরী সভাপতি অধ্যাপক প্রদীপ কুমার দাস জানান এই মেলায় ২৫টি বিদ্যালয় ও ৫টি বিশ্ববিদ্যালয় সমেত মোট ৭৮ টি প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করে। এর সাথে বিগত তিন মাস ধরে ১৮টি বিষয়ের উপর প্রতিযোগিতা ও ৮টি বিষয়ের উপর কর্মশালায় প্রায় ১৮০০ জন এলাকার ছাত্র ছাত্রী অংশ গ্রহন করে।
অনুষ্ঠানের ঘোষক বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব ও বিশ্ববিদ্যালয়ের যুগ্ম নিবন্ধক ড. সৌরভ চন্দ্র উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে সকলকে মেলা পরিদর্শনের জন্য আহ্বান জানান। ছাত্র ছাত্রীদের তৈরি বিজ্ঞানের নানা উদ্ভাবনী মডেল অবশ্যই বিজ্ঞান মেলার প্রধান আকর্ষণ। ঐতিহ্যমণ্ডিত এশিয়াটিক সোসাইটি, মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে সারা বিশ্বে সাড়া জাগানো সংস্থা ইসরো, ভারতীয় প্রাণী সর্বেক্ষণ, ভারতীয় বন সর্বেক্ষণ, ভারতীয় উদ্ভিদ সর্বেক্ষণ, ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ সায়েন্স মিউজিয়াম, জাতীয় কলেরা ও অন্ত্র রোগ সংস্থা (NICED), ভারতীয় কৃষি গবেষণা সংস্থার (ICAR)বিভিন্ন শাখার অভূতপূর্ব অংশগ্রহণ এই মেলার উপযোগিতা অনেকাংশে বাড়িয়ে তুলেছে। আবার তারামণ্ডল, দূরবীণে আকাশ দেখা, কুসংস্কার বিরোধী যুক্তিবাদী প্রদর্শনী, রান্নাঘরে বিজ্ঞান, হ্যাম রেডিও, বিবর্তনের ইতিহাস, খাদ্যে ভেজাল নির্ণয়ের মতো বিষয়গুলি মানুষের মনে কৌতুহল জাগায়। অভিনব ‘ডগ শো’ এই মেলাকে অন্য বিজ্ঞান মেলা থেকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে।
আর আছে বিজ্ঞানের রকমারি বইয়ের সম্ভার নিয়ে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ, পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ, বিজ্ঞান দরবার, গোবরডাঙা গবেষণা পরিষৎ ও দেজ এর মতো বিখ্যাত সংস্থা। এছাড়াও আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের জীবনী নিয়ে প্রদর্শনীসহ বাংলায় বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে যে সকল মনীষীরা অবদান রেখে গেছেন তাঁদের সংক্ষিপ্ত জীবনীসহ ‘বাংলায় বিজ্ঞান চর্চা’র মণ্ডপে বিজ্ঞানের নানা দিকের জ্ঞাতব্য বিষয় যা সাধারণের মননে নিশ্চয়ই আলোড়ন তুলেছে।
বিজ্ঞানের গণ্ডির বাইরে সাহিত্য, চলচ্চিত্র ও নাট্যজগতে পরিবেশ নিয়ে কী ধরনের চর্চা হয় তা নিয়ে সেইসব জগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, শ্রী পার্থ বোস, শ্রী ফাল্গুনী চ্যাটার্জী, শ্রী শ্রীনিবাস অধিকারীদের নিয়ে আলোচনা হয় প্রথম দিন। দ্বিতীয় দিনের আলোচনায় ছাত্র মননে বিজ্ঞান মনস্কতা গড়ে তোলার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে স্বনাম ধন্য অধ্যাপক পার্থ প্রতিম মজুমদার, অধ্যাপক সিদ্ধার্থ দত্ত ও অধ্যাপক তপন মিশ্র। বিজ্ঞানীদের মুখোমুখি ছাত্র ছাত্রীদের নানান প্রশ্ন , যেমন মহাকাশে দূষণ হয় কিনা, মশার কোন উপকারিতা আছে কিনা এই রকম শতাধিক প্রশ্নের উত্তর দেন নাই সেডের অধিকর্তা ড. শান্তা দত্ত, শান্তি স্বরূপ ভাট নগর পুরষ্কার প্রাপ্ত বিজ্ঞানী ড. দীপ্যমান গাঙ্গুলি প্রমুখ। নদী নিয়ে আলোচনায় অংশ নেন বিশিষ্ট চিত্র পরিচালক শতরূপা সান্যাল ও নেশনাল কাউন্সিল অফ সায়েন্সে মিউজিয়াম এর প্রাক্তন অধিকর্তা শ্রী নটরাজ দাশগুপ্ত।
অবশ্যই সাংস্কৃতিক আঙ্গিকে পরিবেশ রক্ষার বার্তা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের আকর্ষণীয় নাচ, গান, নাটকের পরিবেশনা উপস্থিত দর্শকের মন কেড়ে নিয়েছে। আরও ২ দিন এই মেলা চলবে। যাদের দেখার সুযোগ থাকবে তাদের অবশ্যই সে সুযোগ হাতছাড়া করা উচিত হবে না।